ভারত -পাকিস্তান যুদ্ধ 1965 | ১৯৬৫ ভারত - পাকিস্তান যুদ্ধ

ভারত -পাকিস্তান যুদ্ধ 1965 | ১৯৬৫ ভারত - পাকিস্তান যুদ্ধ


    ভারত -পাকিস্তান যুদ্ধ 1965  |

    ১৯৪৭ সালে ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতার ফলে ভারত প্রজাতন্ত্র ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রী পাকিস্তান দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের বিকাশ ঘটে। তারপর থেকে দুটি দেশের মধ্যে বিভিন্ন যুদ্ধ হয়। তার মধ্যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষ নিয়ে মিত্রবাহিনী হিসেবে ডিসেম্বরের বা স্বাধীনতার শেষ কিছুদিন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।তাছাড়া ভারত বাংলাদেশ -পাকিস্তান যুদ্ধে, ভারতে চলে যাওয়া বাংলাদেশের শরনার্থীদের জন্য শরনার্থী শিবির করাসহ বিভিন্ন ভাবে সহযোগীতা করে।মূলত ভারত- পাকিস্তানের সবগুলো যুদ্ধের মূল কারণ কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে।

    পাক-ভারত যুদ্ধ ১৯৬৫ এক অর্থে ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পাক-ভারত যুদ্ধ ছিল দুটি দেশের মধ্যে এক বছরে সংঘটিত তিনটি বিবাদমান ঘটনার ক্রম পরিণতি। এগুলো হলো: এপ্রিল মাসে কুচের রান অঞ্চলে সীমিত আকারের পরীক্ষামূলক যুদ্ধ, আগস্ট মাসে ছদ্মবেশে পাকিস্তানিদের কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ, এবং পরিশেষে সেপ্টেম্বর মাসে পরস্পরের আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রমণ। বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে এই যুদ্ধ শুধু এক বছরের ঘটনার ফলশ্রুতি নয়, সাম্প্রদায়িক পরিবেশে গড়ে ওঠা দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা ও অবিশ্বাসের ফলেই এই যুদ্ধের সূচনা হয়। তা ছাড়া ১৯৪৮ সালের কাশ্মির যুদ্ধ, পরবর্তীকালে কাশ্মিরের একাংশে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ, জম্মু ও কাশ্মিরকে ভারতে অন্তর্ভুক্তি, জাতিসংঘের ভেতরে ও বাইরে প্রতিপক্ষের কূটনেতিক আলোচনা ইত্যাদি ঘটনাবলি পাকিস্তানকে তার পছন্দ অনুযায়ী কাশ্মির সমস্যার একটি সমাধান অর্থাৎ কাশ্মিরকে পাকিস্তানের সঙ্গে অঙ্গীভূত করার প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে ভারতে ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক সাহায্য ইত্যাদি ঘটনায় পাকিস্তান হতাশ হয়ে পড়ে এবং কাশ্মির সমস্যার সমাধান সুদূর পরাহত মনে হয়। আইয়ুব খানের মতো একজন সামরিক শাসকের নিকট একমাত্র সামরিক হস্তক্ষেপ ও যুদ্ধই এই সমস্যার সমাধান বলে প্রতীয়মান হয়।

    যুদ্ধের প্রস্তুতি

    কুচের রান অঞ্চলের ঘটনা- কুচের রান অঞ্চল হচ্ছে ভারতের গুজরাট রাজ্য এবং পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ৩২০ মাইল দীর্ঘ এবং ৫০ মাইল প্রশস্ত এক মরুময় অঞ্চল এবং জলাভূমি। দেশ বিভাগের সময় এবং রান অঞ্চলের কর্তৃত্ব নিয়ে বাউন্ডারি কমিশনের ব্যর্থতার কারণে প্রায় ৩৫০০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে দুটি নতুন দেশের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। ১৯৬৫ সালের ৯ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিরোধপূর্ণ এলাকায় জোরপূর্বক প্রবেশ করে এবং দাবি করে যে ভারতীয় সেনাবাহিনী কাঞ্জারকোটের নিকট একটি পাকিস্তানি চৌকিতে আক্রমণ করেছে। এই যুদ্ধ অতি দ্রুত তীব্রতর হয় এবং পাকিস্তান আমেরিকা থেকে সংগৃহীত নতুন প্যাটন ট্যাংক এই যুদ্ধে ব্যবহার করা শুরু করে। পরিশেষে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসনের মধ্যস্থতায় এবং ভারত ও পাকিস্তানে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনারদের (যথাক্রমে জন ফ্রিম্যান ও স্যার মরিস জেম্স) প্রচেষ্টায় ১৯৬৫ সালের ১ জুলাই থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।

    অবশ্য কুচের রান অঞ্চলের ঘটনার কয়েক বছর পূর্ব থেকেই বেশ কিছু ঘটনা ঘটে এবং এ নিয়ে বহু বিবৃতিও প্রকাশিত হয়। এসব ঘটনা ও বিবৃতি দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতিতে সাহায্য করে। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘ সীমান্ত রেখায় সীমানা লঙ্ঘনসহ অন্যান্য ঘটনা নিত্য নৈমিত্তিক ছিল। ১৯৬৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ বিরতি সীমানা রেখা বরাবর নিয়োজিত জাতিসংঘের সামরিক পর্যবেক্ষক দল ভারত ও পাকিস্তান কর্তৃক ২২৩১টি অভিযোগের কথা উল্লেখ করে। এই সময়ের মধ্যে পর্যবেক্ষক দল ৩৭৭টি সীমানা রেখা লঙ্ঘনের বিষয় নিশ্চিত করে যার মধ্যে ২১৮ টি পাকিস্তান কর্তৃক এবং ১৫৯ টি ভারত কর্তৃক লঙ্ঘন করা হয়। আইউব খান সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করেন যে, কাশ্মির সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান হলে পাকিস্তান সরকার আর যুদ্ধ করবে না। কারণ কাশ্মির সমস্যা ‘আমাদের নিরাপত্তা ও সমগ্র অস্তিত্ত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।’ ভারত কর্তৃক ‘যুদ্ধ-নয় চুক্তি’ প্রস্তাবের উত্তরে তিনি মন্তব্য করেন, ‘... যদি কাশ্মির বিতর্ক থেকেই যায়, তাহলে ভারতের


    ১৯৬৫ ভারত - পাকিস্তান যুদ্ধ 


    সেপ্টেম্বর যুদ্ধ আন্তর্জাতিক সীমানা রেখা বরাবর পাঞ্জাব ফ্রন্ট খোলার পদক্ষেপ গ্রহণের কৃতিত্ব ছিল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর। কাশ্মির উপত্যকার সঙ্গে স্থলপথে যোগাযোগের মাধ্যমে একে রক্ষা করা এবং নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বিরাট পদক্ষেপ। ভারতীয় সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক সীমানা রেখা বরাবর একই সঙ্গে দুটি আক্রমণ পরিচালনা করে। প্রথমটি ছিল ৬ সেপ্টেম্বর লাহোর অভিমুখে, এবং অন্যটি ছিল পরদিন শিয়ালকোট শহর অভিমুখে। পাকিস্তান এই শিয়ালকোট শহরকেই কাশ্মিরের চাম্ব সেক্টরে সেনাবাহিনী পাঠানোর জন্য ব্যবহার করে আসছিল। লাহোর আক্রমণ কিছু প্রাথমিক সাফল্য লাভ করে, কিন্তু ফেরার পথে সারিবদ্ধ পানিসেচ খালের কারণে তারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই পানিসেচ খালের উপর নির্মিত প্রায় ৭০টি সেতু বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিয়ে সেখানে পরিখার সৃষ্টি করে। অবশ্য পাকিস্তান ভারত অধিকৃত পাঞ্জাবের খেমখারান নামক একটি ছোট শহরে প্রতি-আক্রমণ পরিচালনা করে। ১২০ থেকে ১৫০টি ট্যাংক ও অন্যান্য সেনাযানে সজ্জিত সক্রিয় ও শক্তিশালী পাকিস্তানের প্রথম সশস্ত্র বাহিনী এই আক্রমণ পরিচালনা করে। কিন্তু ভারতীয় বাহিনীর পূর্বে অবস্থান নেয়া অ্যাম্বুশের কারণে পাকিস্তানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও বহু প্রাণহানি ঘটে। অন্যদিকে শিয়ালকোট রণক্ষেত্রে উভয়পক্ষের ৪০০ থেকে ৬০০টি ট্যাংক বহর নিয়ে সর্ববৃহৎ ট্যাংক যুদ্ধ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে পাকিস্তান সাফল্যলাভ করে এই অর্থে যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী শিয়ালকোট অভিমুখে অভিযান বন্ধ করে দেয়। যুদ্ধ চলতে থাকলে উভয়পক্ষ একটি যুদ্ধবিরতির দিকে নমনীয় হয়ে পড়ে। প্রথমত বিশেষ করে পাকিস্তানের সামরিক অবস্থান ধীরে ধীরে দুর্বল হতে শুরু করে, তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সেনাব্যুহ ভাঙতে ব্যর্থ হয়; দ্বিতীয়ত, সেনাবাহিনীর রসদ সরবরাহ, বিশেষ করে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ ক্রমশ হ্রাস পেতে শুরু করে। বিশেষ করে খেমখারান রণক্ষেত্রে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রচুর সংখ্যক ট্যাংক আটক করে। একই সময়ে পাকিস্তানের কাশ্মির প্রচারণার গুরুত্ব হারিয়ে যায় কারণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে তাদের গতিবেগ ভিন্ন দিকে পরিচালিত করতে এবং পাঞ্জাব রণক্ষেত্রের দিকে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। জাতিসংঘ ফোরামের বাইরে ব্রিটিশ আমেরিকার কার্যকর সমর্থন পেতেও পাকিস্তান ব্যর্থ হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের মহাসচিব ২০ সেপ্টেম্বর অত্যন্ত কঠোর ভাষায় যুদ্ধ বিরতির জন্য সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করলে ভারত ২১ সেপ্টেম্বর এবং পরের দিন পাকিস্তান তা গ্রহণ করে।

    Tag: ভারত -পাকিস্তান যুদ্ধ 1965 | ১৯৬৫ ভারত - পাকিস্তান যুদ্ধ