প্রবন্ধ রচনা একটি বর্ষণমুখর রাত এবং এ বিষয়ে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর

 

প্রবন্ধ রচনা একটি বর্ষণমুখর রাত, বর্ষণমুখর প্রবন্ধ রচনা, একটি বর্ষণমুখর রাত প্রবন্ধ রচনা,


    প্রবন্ধ রচনা একটি বর্ষনমুখর রাত


    (সংকেত: সূচনা; বর্ষনমুখর রাত উপভোগের সুযোগ; বর্ষণমুখর রাতের বর্ণনা; উপসংহার।)


    সূচনা:


    আজ বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে

    চলেছে গরজি, চলেছে নিবিড় সাজে

    রবি ঠাকুরের এ বাণী আমাদের বাঙালি জীবনে বর্ষার আবেদন কতখানি তা উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। বর্ষা তার অপার সৌন্দর্য ও করুণা দিয়ে বাংলার প্রকৃতি ও তার সন্তানদের পরিপুষ্ট করে রাখে। এই বর্ষা মানব মনের সাথেও সর্বদা বিচিত্র খেলায় মত্ত থাকে। একই অঙ্গে বহুরূপ ধারণকারী বর্ষা রাতের অন্ধকারে যে অপার সৌন্দর্য নিয়ে আবির্ভূত হয়, তা বাক্য-কথায় আবদ্ধ করা যায় না। এ শুধু নীরবে অনুভব করতে হয়। বর্ষনমুখর রাত আমার জীবনে বহুবার ধরা দিয়েছে। কিন্তু এক নিভৃত পল্লীর বর্ষণমুখর রাতকে আমি জীবনে প্রথম উপলব্ধি করি। রাতটি এখনও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে এক নিভৃত পল্লীর মানুষের প্রথম প্রণয়ের স্মৃতির মতো। সেই রাতের অনুভূতি আমায় মনকে হাসায়, বারবার শিহরিত করে।

    বর্ষনমুখর রাত উপভোগের সুযোগ: আমি শহরে বাস করি। শহরের ইট-কাঠের খাঁচায় বর্ষণমুখর রাতকে কখনও খুঁজে পাওয়া যায় না। মানব সভ্যতার এ আগ্রাসনে বর্ষাদেবী শহরে তাঁর করুণা বর্ষণ করলেও, নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মেলে ধরতে পারেন না। এ বর্ষণে তাই কোনো ছন্দ থাকেনা, গন্ধ থাকে না, ভাষা থাকে না। আমার জীবনে তাই বর্ষা আগে ছিল শুধু বিন্দু বিন্দু জলকণার অবিরাম পতন। বর্ষণমুখর রাতকে আমি প্রথম উপলব্ধি করতে শিখি আমার এক দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে। বিয়েটা ছিল মধুমতি নদীর পাড়ের প্রত্যন্ত এক গ্রামে। ছবির মতো সাজানো গোছানো, সবুজ প্রকৃতির অপার স্নেহ মমতায় লালিত সে গ্রাম। শ্রাবণ মাসের সেই গ্রাম্য প্রকৃতিতে বর্ষাদেবী উন্মুক্ত করেছিল তার পরিপূর্ণ রূপ। তাইতো বার বার রবি ঠাকুরের সেই কথা মনে আসছিল,


    বর্ষণমুখর রাত প্রবন্ধ রচনা


    আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান

    দিয়ো তোমার জগৎসভায়

    এইটুকু মোর স্থান।

    বর্ষণমুখর রাতের বর্ণনা: আমার জীবনে সেই বর্ষণমুখর রাতটি আমার স্মরণীয় ঘটনাগুলোর মধ্যেই পড়ে। সেই বর্ষণমুখর রাতের স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে সেই বিয়ে বাড়ির উঠোন, ঘর, কোলাহল, সাজসজ্জা। আর সেখানকার মানুষের সরলতা। প্রথম সেদিন সন্ধ্যায় যখন বিয়ে বাড়িতে পা রাখলাম, তখন মাত্র এক পশলা বৃষ্টি শেষ হয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়েছে। গোধূলীর আলো সারা উঠোন জুড়ে এক মোহনীয় হলুদ রঙের আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। হলুদ আভায় পূর্ণ এই কনে দেখা আলোতে লাল-পাড় হলুদ শাড়ী পরা কিশোরীরা খালি পায়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছিল। কৃষ্ণচূড়া ফুল যেমন প্রকৃতির অন্যসব সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে আমাদের চোখে আপন মহিমায় আভাসিত হয়, সেই কিশোরীদেরও তখন সেরকম মনে হচ্ছিল। তাদের প্রাণখোলা হাসি ও চঞ্চলতা বিয়ে বাড়িকে প্রাণবন্ত করে রেখেছিল। আর বিয়ে বাড়িতে গ্রামের আত্মীয়দের সাদর আমন্ত্রণ ও স্নেহ আমাকে মুগ্ধ করল। এ স্নেহে এক আদিম টান ও ভালোবাসা ছিল। আমরা সাধারণত শহরের বিয়ে বাড়িতে আড়ম্বরতা ও কৃত্রিমতা দেখতে পাই। কিন্তু এ গ্রাম্য বিয়ে ছিল সকল বাহুল্য বর্জিত। না ছিল নিওন আলোর চাকচিক্য, না ছিল সাউন্ড সিস্টেমের গগনবিদারী চিৎকার। লাল-নীল কাগজ, গাদা ফুল, কলাগাছ, হ্যাজাক লাইট এগুলোই ছিল গ্রাম্য বিয়ের অনুষঙ্গ। এর সাথে প্রকৃতি ও বর্ষার আয়োজন মিলেমিশে একাকার হয়েছিল। বিয়ে বাড়িতে রাত নামার কিছুক্ষণ পরে মাদল বাজাতে বাজাতে ও বিদ্যুৎ ঝলকানির খেলা দেখাতে দেখাতে কোথা হতে যেন মেঘরাজ তার সৈন্যদল নিয়ে আকাশটাকে দখল করে ফেললো। শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টির কারণে বরপক্ষের বাড়ীতে পৌঁছাতে বিলম্ব হয়েছিল। তাই এ হঠাৎ-বিরতিতে কিছুক্ষণের জন্য বিয়ে বাড়ীর কর্মকোলাহল এক অজানা নিস্তব্ধতার চাদরে ঢাকা পড়লো। এ কোনো বেদনার নিস্তব্ধতা নয়, এটা যেন কিছুক্ষণের জন্য প্রকৃতির এ আয়োজনকে নীরবে নিভৃতে উপলব্ধি করা।জানালার পাশে একা বসে আছি। বাইরে বৃষ্টির অবিরাম ছন্দবদ্ধ সঙ্গীত। প্রকৃতি অন্ধকারের চাদরে ঢাকা এবং বৃষ্টির চাদর যেন এ অন্ধকারের উপর আলাদা আবরণ সৃষ্টি করেছে। গাছের পাতাগুলো বৃষ্টির পানিতে মৃদু মন্দ কাঁপছে। জলের শব্দ ও বৃষ্টির গন্ধ পুরো পরিবেশকে তখন মোহনীয় করে তুলেছে। খড়ের চালের পানি মাটির ঘরের কিনারা দিয়ে পড়ে এক নির্দিষ্ট শৃঙ্খলায় বয়ে চলেছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো স্রোতস্বিনী নদী তার বুক ভরে পলি নিয়ে অন্য অজানা কোনো ভূমিকে পরিপুষ্ট করতে প্রবলবেগে ছুটে চলছে। ঘরের দরজার কাছে, খেজুর গাছের তৈরি সিঁড়ির গোড়ায় কতগুলো হাঁস জড়ো হয়ে মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজছে। আর মাঝে মাঝে অসাধারণ নৃত্যের ভঙ্গিমায় পাখা ঝাড়া দিয়ে উঠছে। নিজের অজান্তেই মনের গহীনে তখন বাজতে শুরু করেছে- “মেঘের পরে মেঘ জমেছে/আঁধার করে আসে/আমায় কেন বসিয়ে রাখ/একা দ্বারের পাশে।বহুবার শুনেছি রবি ঠাকুরের এ গান। কিন্তু কখনও মন থেকে উপলব্ধি করতে পারিনি। সেদিনই প্রথম আবিষ্কার করলাম এ গানের মর্ম কথাকে। কেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ষাকে নিয়ে এত আকুলতা, কবি সাহিত্যিকদের এত আয়োজন সেটা সেদিন বুঝলাম। এ বর্ষা এক ধরণের মাদকতা তৈরি করে, একে পুরোপুরি পাওয়া যায় না, শুধু অনুভব করতে হয়। এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে হয়। বর্ষার রাতে গরম খিচুরি, ভূনা মাংস ও ইলিশ মাছ ভাজাও আমার কাছে বর্ষার অনুষঙ্গ। সম্পূর্ণ পরিতৃপ্তি সহকারে সেই গরম ভাপ ওঠা খিচুরির প্লেটে মাংস ভূনা ও ইলিশ মাছের স্বাদ আমার স্মৃতিতে আজও অম্লান।


    একটি বর্ষণমুখর রাত রচনা


    উপসংহার: বর্ষণমুখর রাতের বর্ণনা আমরা যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায়, গানে পাই, কালিদাসের মেঘদূতে পাই তেমনি পাই পাশ্চাত্যের এমিলি ভিকসন, থমাস হারডি’র কবিতায়। বর্ষণ মুখর রাত প্রকৃতপক্ষেই প্রেমময়ী হিসাবে আবির্ভূত হয়। এ রাত হৃদয়ে যে আমেজ সৃষ্টি করে তা মনের সব ব্যথা-বেদনাকে নিঃশেষ করে দেয়। বৈষ্ণব কবির সুললিত কবিতার কথাই তখন মনে পড়ে-


    “রজনী শাওন ঘন ঘন দেয়া গরজন রিমিঝিমি শব্দে বরিষে

    পালঙ শয়ান রঙে বিগলিত চির অঙ্গে

    নিন্দ যাও মনের হরিষে।”


    Tag: প্রবন্ধ রচনা একটি বর্ষণমুখর রাত, বর্ষণমুখর প্রবন্ধ রচনা, একটি বর্ষণমুখর রাত প্রবন্ধ রচনা,