প্রবন্ধ রচনা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন এবং এ বিষয়ে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর

প্রবন্ধ রচনা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট রচনা, বাংলা রচনা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট,


     প্রবন্ধ রচনা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন


    (সংকেত: ভূমিকা; সুন্দরবনের আয়াতন ও অবস্থান; সুন্দরবনকে ম্যানগ্রোভ বন বলার কারণ; সুন্দরবন নামকরণ ও বিশ্বস্বীকৃতি; সুন্দরবন পরিচিতি; প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি; সুন্দরবনের অর্থনৈতিক গুরুত্ব; সুন্দরবন রক্ষা; উপসংহার।)


    ভূমিকা: বাংলাদেশের জাতীয় বন হলো সুন্দরবন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও ঐশ্বর্যমন্ডিত বনগুলোর মধ্যে আমাদের সুন্দরবন অন্যতম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি এ বন। এর চার দিক নিবিড় ঘন, চিরসবুজ এবং নিস্তব্ধ। সর্বত্রই সবুজের রাজত্ব। গাছপালা অপরূপ সাজে সজ্জিত। ভারতীয় উপমহাদেশে সুন্দরবনের মতো এতো বড় অরণ্যসঙ্কুল বন আর নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের সৌন্দর্যের মধ্যমণি হয়ে সুন্দরবন শোভাবর্ধণ করে যাচ্ছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ভয়াল গর্জন, হরিণের ছোটাছুটি, পাখিদের কিচিরমিচির, সুন্দরবনের চির পরিচিত দৃশ্য। বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ সুন্দরবনের আরেক নাম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট।


    ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট রচনা


    সুন্দরবনের আয়াতন ও অবস্থান: পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এ ম্যানগ্রোভ বনের আয়তন ৫৭৪৭ বর্গ কি.মি বা ২৪০০ বর্গ মাইল। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেষে জেগে আছে সুন্দরবন। বাংলাদেশের পাঁচটি জেলা ঘিরে সুন্দর বনের অবস্থান। এগুলো হলো খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনা, পটুয়াখালী। বাংলাদেশে সুন্দরবনের ৬২ ভাগ অবস্থিত আর বাকি ৩৮ ভাগ ভারতে অবস্থিত। তবে বাংলাদেশে এর অবস্থান বেশি বলে একে এদেশের বন হিসাবেই গণ্য করা হয়।


    সুন্দরবনকে ম্যানগ্রোভ বন বলার কারণ: লোনা পানি বা কাদার মধ্যে জেগে থাকা খুঁটির মতো এক ধরণের শ্বাস গ্রহণকারী শিকড় বিশিষ্ট উদ্ভিদের অরণ্যকে বলে ম্যানগ্রোভ বন। যে বনে এ ধরণের উদ্ভিদ খুব বেশি পরিমাণে জন্মে সে বনকেই ম্যানগ্রোভ বন বলে। বিশ্বের গ্রীষ্মম-লীয় উপকূলে এ বনের অবস্থান বেশি। ম্যানগ্রোভ বনের সকল বৈশিষ্ট্যই সুন্দরবনের রয়েছে বলে সুন্দরবনকে ম্যানগ্রোভ বন বলা হয়। আর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বা লোনা পানির বন হলো সুন্দরবন।


    সুন্দরবন নামকরণ ও বিশ্বস্বীকৃতি: বিশ্বের প্রতিটি নিদর্শনের নামকরণে কোনো না কোনো কারণ থাকে। সুন্দরবনেরও তেমনই রয়েছে। এ বনের বৃক্ষকূলের মধ্যে অন্যতম হলো সুন্দরী বৃক্ষ। এ বনে প্রচুর পরিমাণে সুন্দরী বৃক্ষ জন্মে বলেই এ বনকে সুন্দরবন বলা হয়। সুন্দরী বৃক্ষের কাঠে মজবুত তক্তা হয় এবং তা নৌকা ও ঘরের দরজা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। সুন্দর বন পৃথিবীর অন্যতম বৈচিত্র্যপূর্ণ বন। যার স্বীকৃতি স্বরূপ জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কো (UNESCO) ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসাবে ঘোষণা করে। বিশ্ব ঐতিহ্যের ক্রমানুসারে সুন্দরবনের অবস্থান ৫২২তম। এ বিরল সম্মাননা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা।


    বাংলা রচনা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট


    সুন্দরবন পরিচিতি: বিশ্ব ঐতিহ্যের অপরূপ নিদর্শন হিসাবে সুন্দরবনের রয়েছে অনন্য পরিচিত। যা শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্ব সভ্যতার জন্য ঈশ্বরের উপহার স্বরূপ। নিচে এ বনের নিদর্শনগুলো তুলে ধরা হলো-


    গাছপালা: বৃক্ষ ছাড়া বন কল্পনা করা যায় না। এক্ষেত্রে সুন্দরবন অনন্য, অসাধারণ। কারণ সুন্দরবনে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন রকমের গাছপালা রয়েছে। বিশেষ করে সুন্দরী গাছের কথা বলতেই হয়। কেননা এ গাছের নাম অনুসারেই সুন্দরবনের নামকরণ করা হয়েছে। সুন্দরী গাছ ছাড়াও সুন্দরবনে যেসব গাছ রয়েছে সেগুলো হলো- গেওয়া, পশুর, ধুন্দুল, বাঁশ, বাইন, গরান, গর্জন, সেগুন, আমলকি, বৈলাম, কেওড়া, গোলপাতা প্রভৃতি ।


    পশু-পাখি: পৃথিবীর বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাস ভূমি হলো সুন্দরবন। পৃথিবীর একমাত্র সুন্দরবনেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার বাস করে। এছাড়াও সুন্দরবনে নানা ধরণের পশু বিচরন করে। এগুলো হলো- কুমির, হরিণ, সাপ, বানর, মৌমাছি, চিতাবাঘ, সজারু, শয়াল, বন মোরগ, বন বিড়াল প্রভৃতি। আর সুন্দরবনে প্রচুর পরিমাণে পাখ-পাখালির সমাগমও চোখে পড়ার মতো। সুন্দরবনের পাখ-পাখালির মধ্যে রয়েছে শালিক, টিয়া, ময়না, কোকিল, বক, হাঁস, টুনটুনি, ফিঙে, শকুন, মাছরাঙ্গা প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


    মৎস্য: সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর মধ্যে মাছ অন্যতম। সুন্দরবনের বুকের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে অনেক নদ-নদী, খাল-বিল। সুন্দরবন যেহেতু লোনা পানির বন তাই এ বনের লোনা পানির মাছও পাওয়া যায় প্রচুর। সুন্দরবনের মাছের মধ্যে রয়েছে -করাল, বোয়াল, রূপচাঁদা, চিংড়ি, রুই, কাতল ছাড়াও নানা ধরণের মাছ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় এ বনের খাল-বিল নদ-নদীগুলোতে।


    প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি: সুন্দরবনকে বলা হয় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রাণী। কেননা এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুধু সবুজের সমারোহ। যা দেখলে শুধু-অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে মন চায়। নিবিড় ঘন, চির সবুজ এবং নিস্তব্ধ এই সুন্দরবনে সর্বত্র সবুজের রাজত্ব। সুন্দরবন প্রতিনিয়ত সৌন্দর্য পিপাসু হৃদয়কে আকর্ষণ করে প্রবলভাবে। সুন্দরবনের বাঘের গর্জন, পাখিদের কিচির-মিচির, বনের ফাঁকে ফাঁকে এক ফালি রোদের উঁকিঝুঁকি, বৃক্ষ লতাদের বাতাসে দোল খাওয়া, নদীতে মৎসকুলের খেলা এসব কিছুই যেন এক একটি সৌন্দর্যের প্রকাশ। এছাড়া হিরণ পয়েন্টসহ ছোট ছোট চর বা দ্বীপ সুন্দরবনকে করে তুলেছে আরও আকর্ষণীয়। তাই তো প্রতিনিয়ত বাংলদেশসহ বিশ্বের নানা দেশ থেকে পর্যটকেরা ছুটে আসে এ ম্যানগ্রোভ বনে। স্বীয় নয়ন দ্বারা সৌন্দর্যপিপাসু ব্যক্তিরা উপভোগ করে ম্যানগ্রোভ বনের সৌন্দর্য।


    সুন্দরবন সম্পর্কে রচনা


    সুন্দরবনের অর্থনৈতিক গুরুত্ব: সুন্দরবনের প্রত্যেকটি উপাদানই অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। সুন্দরবনের বৃক্ষের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান হলো পশুর গাছের কাঠ। এছাড়া সুন্দরী, গেওয়া গাছের কাঠেরও সুনাম রয়েছে দেশে-বিদেশে। কারণ এর কাঠ পেন্সিলের কাঠ, দিয়াশলাইয়ের কাঠি, নিউজপ্রিন্ট কাগজ, দৈনন্দিন আসবাপত্র, নৌকা, প্রভৃতি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া সুন্দরবনের মৎস্যকুল আয়ের একটা বড় উৎস, যেখান থেকে কোনো প্রকার বিনিয়োগ ছাড়াই প্রচুর অর্থ উপার্জন করা সম্ভব। মৌয়ালিরা সুন্দরবন থেকে প্রচুর মধু ও মোম সংগ্রহ করে, যা দেশের মধু চাহিদা পূরণের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। এগুলো ছাড়াও সুন্দরবন নানা ধরণের পশু-পাখির জন্য বিখ্যাত। সুন্দরবনে প্রায় ৪২ প্রজাতির প্রাণীর বাস। যা শুধু সুন্দরবনকেই সমৃদ্ধ করেনি বরং সমৃদ্ধ করেছে এদেশের অর্থনীতিকে। প্রতিবছর এখান থেকে কাঠ, মাছ, প্রাণী দেশে-বিদেশে রপ্তানি করা হয়। যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছে।


    সুন্দরবন রক্ষা: সুন্দরবন প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যের আকর। যা শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো পৃথিবীর জন্যই গৌরবের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বর্তমানে কিছু কুচক্রী মহল সুন্দরবনের সৌন্দর্য বিনষ্টে তৎপর রয়েছে। তারা অবাধে ধ্বংস করছে বৃক্ষ, আশেপাশে গড়ে তুলছে কলকারখানা। যা আমাদের দেশসহ বিশ্ব পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। এছাড়া এক শ্রেণির পাচারকারী শিকারিরা পৃথিবী বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, কুমির, পাখ-পাখালি, মৎস্য অবাধে শিকার করে চলছে। তাদের হীনস্বার্থ আর লোভের কারণে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে পৃথিবীর বিখ্যাত এ ম্যানগ্রোভ বন। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো একদিন সুন্দরবন হারাবে তার সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য, যা আমাদের জন্য মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনবে। তাই সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য সর্বদা অতন্দ্র প্রহরীর মতো থাকতে হবে। দৃঢ় হাতে দমন করতে হবে কুচক্রীদের। এছাড়া বৃদ্ধি করতে হবে জনসচেতনতা। যাতে সকল শ্রেণির মানুষ সুন্দরবন রক্ষায় এগিয়ে আসতে পারে।


    উপসংহার: বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রাণী হলো সুন্দরবন। প্রকৃতি তার সকল সৌন্দর্য যেন নির্ধিদায় ঢেলে দিয়েছে এ ম্যানগ্রোভ বনের বুকে। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে দিয়েছে অসীম মর্যাদা। দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে এর সম্পদ। এদেশের পরিবেশের উপরও সুন্দরবনের প্রভাব অপরিসীম। তাই সকল কুচক্রী থেকে মুক্ত রাখতে হবে এ বনকে। কেননা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এ ম্যানগ্রোভ বন শুধু আমাদেরই নয় পুরো বিশ্বের।


    Tag: প্রবন্ধ রচনা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট রচনা, বাংলা রচনা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট,