প্রবন্ধ রচনা বাংলাদেশের লোকসাহিত্য এবং এ বিষয়ে প্রশ্ন ও উত্তর - Time Of BD - Education Blog

হ্যাপি নিউ ইয়ার ২০২৩ ভিজিটর বন্ধুরা। দোয়া করি, এই বছরের প্রতিটি মুহুর্ত যেনো সকলের অনেক আনন্দে কাটে।

প্রবন্ধ রচনা বাংলাদেশের লোকসাহিত্য এবং এ বিষয়ে প্রশ্ন ও উত্তর

 

প্রবন্ধ রচনা বাংলাদেশের লোকসাহিত্য, বাংলাদেশের লোকসাহিত্য প্রবন্ধ রচনা, বাংলা লোক সাহিত্যের ধারা রচনা, লোক সাহিত্যের ইতিহাস প্রবন্ধ রচনা,


    প্রবন্ধ রচনা বাংলাদেশের লোকসাহিত্য


    (সংকেত: ভূমিকা; লোকসাহিত্যের সংজ্ঞা; বাংলাদেশের লোকসাহিত্য; লোকসাহিত্যের বিষয়; ছড়া ও স্বপ্নের জগৎ; লোকগীতি; গীতিকা সাহিত্য; রূপকথা; উপকথা; ব্রতকথা; ধাঁধা; প্রবাদ-প্রবচন; লোকসাহিত্য সংরক্ষণ; উপসংহার।)


    ভূমিকা: বাংলা লোকসাহিত্য এক অমূল্য সম্পদ। পল্লী বাংলার সহজ সরল মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ, আনন্দ-বেদনার কথা অতি সহজেই ফুটে উঠে লোক সাহিত্যের মাধ্যমে। লোকসাহিত্যে নেই কোনো কালের বাঁধন। এর ঐতিহ্য হাজার বছরের। লোকসাহিত্য কোনো ব্যক্তি বিশেষের সৃষ্টি নয়, সমাজের সাধারণ মানুষের সৃষ্টিশীলতার প্রতীক এটি। জগৎ ও জীবন থেকে সৃষ্ট এ সাহিত্য ক্রমান¦য়ে মানুষের মুখে মুখে ফিরে নতুন নতুন রূপ লাভ করে। বৈচিত্র্য ও ব্যাপকতায় এটি বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।


    লোকসাহিত্যের সংজ্ঞা: Folklore কথাটির বাংলা প্রতিরূপ লোকসাহিত্য। ফোকলোর কথাটির উদ্ভাবক উইলিয়াম থমাস। ১৮৪৮ সালে সর্বপ্রথম লন্ডনে Folklore Society প্রতিষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন পন্ডিত ‘লোকসাহিত্য’ শব্দটিকে Folklore শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে মানতে রাজি নন। কারণ ইংরেজি Folklore শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। ফলে তারা লোকসাহিত্যের পরিবর্তে লোকবিজ্ঞান, লোকশ্রুতি, লোককথা ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। যে সাহিত্য পল্লীবাংলার সহজ সরল মানুষের মনে আপনা থেকেই জন্ম নেয়, যেখানে কোনো আড়ম্বরতা থাকে না এবং যা নদীর স্রোতের মতো মানুষের মনে বহমান তাই লোকসাহিত্য। শহরের সাহিত্যকে সাজানো ফুলবাগিচার সাথে তুলনা করলে লোকসাহিত্যকে তুলনা করা হবে বনফুলের সঙ্গে।


    বাংলাদেশের লোকসাহিত্য প্রবন্ধ রচনা


    বাংলাদেশের লোকসাহিত্য: ভাষা সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকেই লোক সাহিত্যের উদ্ভব। যুগযুগ ধরে এ সাহিত্য মানুষের অগোচরে লালিত হচ্ছে। শিক্ষিত সমাজে এর স্থান না হলেও পল্লী বাংলার মানুষের হৃদয়ের সবটুকু স্থান দখল করে আছে লোকসাহিত্য। মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত গান, কাহিনী, গাঁথা, ছড়া, প্রবাদ, ধাঁধা ইত্যাদি লোকসাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রকৃতির অতি সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোও প্রকাশ পেয়েছে লোকসাহিত্যে। বাংলাদেশের প্রকৃতিই এ দেশের মানুষকে কাব্যিক করে তুলেছে। বাংলাদেশের নদী-নালা, দিগন্ত-বিস্তৃত মাঠ, পাখ-পাখালি, স্নিগ্ধ পরিবেশ এদেশের মানুষকে কল্পনাপ্রবণ ও আবেগপ্রবণ করেছে। ফলে তারা মনের সহজ প্রবণতা থেকেই সাহিত্য রচনা করে। ময়মনসিংহ, পাবনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা এবং উত্তরবঙ্গে লোকসাহিত্যের প্রাচুর্যতা বেশি।


    লোকসাহিত্যের বিষয়: বাংলা লোকসাহিত্য নদীর মতো প্রবাহিত। যা আপন স্রোতধারায় বিচিত্র। এতে জীবনের বিচিত্র রং ও বর্ণ ব্যবহার করে জীবনকে ফুটিয়ে তোলা হয় অতি সহজ ভাষায়। বিষয় বৈচিত্র্যের দিক থেকে লোকসাহিত্যকে প্রধানত ছয়টি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- ১) ছড়া ২) গান ৩) গীতিকা ৪) কথা ৫) ধাঁধা ৬) প্রবাদ প্রবচন।এছাড়া মঙ্গল কাব্য, পাঁচালী, বাউল, শ্যামাসঙ্গীত, লোকসাহিত্যের এক একটি প্রধান শাখা। যাত্রা, কবিগান, আখড়াই ও টপ্পা প্রভৃতি রচিত হয়েছে মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের সন্ধিক্ষণে। এগুলো ছিল বাংলার লোক শিল্পের বাহন।


    ছড়া ও স্বপ্নের জগৎ: লোকসাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হলো ছড়া। প্রধানত শিশুদের আনন্দদানের জন্য ছড়া রচিত হয়েছিল। সাবলীল ভাষায় শিশুর মনে আনন্দের খোরাক জোগায় এই ছড়াগুলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘ছেলে-ভুলানো ছড়া’ অনেকগুলো ছড়াকে সংগ্রহ করে সংরক্ষিত করেছেন। ছড়াগুলো শিশু হৃদয়ে কল্পনার রাজ্য তৈরি করে। যেমন-


    ‘আম পাতা জোড়া /মারব চাবুক চড়ব ঘোড়া ওরে বুবু সরে দাঁড়া/আসছে আমার পাগলা ঘোড়া।

    পাগলা ঘোড়া খেপেছে/চাবুক ছুড়ে মেরেছে।’

    লোকগীতি: লোকসাহিত্যের অন্যতম উপকরণ লোকগীতি। লোকগীতিতে গ্রামের সহজ সরল রূপটি ধরা পড়ে। লোকগীতি লোকের মুখে মুখে ফিরে নিত্যনতুন রূপ লাভ করে। লোকগীতিতে জীবনের জটিলতা নেই। স্বচ্ছ পানির মতোই স্বচ্ছ এর গাঁথুনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার জমিদারি কাজ পরিচালনা করতে পাবনা গিয়েছিলেন। সেখানে মাঝির কণ্ঠে লোকগান শুনে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন-


    ‘যুবতী ক্যান বা কর মন ভারী

    পাবনাই থ্যাহে আন্যে দেব ট্যাহা দামের মেটেরি।’

    পল্লীর মাঠে ঘাটে ছড়িয়ে রয়েছে জারি, সারি, ভাটিয়ালী, মুর্শিদী, রাখালি, মারফতি গান। এই গানগুলোর ভাষা ও সুর বিচিত্র। এগুলোর মধ্যে মিশে আছে প্রেম, আনন্দ, সৌন্দর্য ও তত্ত্বজ্ঞান। ভাটিয়ালি সুরে মাঝি গান গায়-

    ‘মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে

    আমি আর বাইতে পারলাম না

    সারা জনম উজান বাইলাম

    ভাটির নাগাল পাইলাম না।’

    গীতিকা সাহিত্য: Ballad বা গীতিকা লোকসাহিত্যের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। গীতিকা সাহিত্যে সাধারণত কোনো দৈব দুর্ঘটনা বা কোনো বিয়োগান্ত প্রেমকাহিনীর বর্ণনা থাকে। গীতিকা সাহিত্যের মধ্যে অন্যতম হলো নাথ-গীতিকা, মৈয়মনসিংহ গীতিকা এবং পূর্ববঙ্গ গীতিকা। বাংলা লোকসাহিত্যের আকাশে মৈয়মনসিংহ গীতিকা উজ্জ্বল নক্ষত্র। মহুয়া, মলুয়া, সোনাই, কাজল রেখা, লীলাবতী এক একটি উজ্জ্বল অংশ। মহুয়া পালার দুটি পঙক্তি-


    ‘জলভর সুন্দরী কন্যা জলে দিছ ঢেউ,

    হাসি মুখে কও না কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ।


    লোক সাহিত্যের ইতিহাস প্রবন্ধ রচনা


    রূপকথা, উপকথা, ব্রতকথা: বাংলায় শিশু-সাহিত্যের শাখায় পড়ে রূপকথা ও উপকথা। মেয়েলি ব্রতের সঙ্গে সম্পর্কিত কাহিনী অবলম্বনে তৈরি হয় ব্রতকথা। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার প্রচলিত রূপকথাগুলোকে লিখিত রূপ দিয়েছেন। তাঁর ‘ঠাকুরদার ঝুলি’ ঠাকুরমার ঝুলি’ রূপকথার গ্রন্থ হিসেবে সুপরিচিত। মেয়েলি ব্রতকথাগুলো লৌকিকদের দেবীর মাহাত্ম্যগানের উদ্দেশ্যে রচিত। ব্রতকথাগুলো বাংলা আদিমকাব্য। বিভিন্ন ধরণের ব্রত রয়েছে। যেমন: সেঁজুতি ব্রত, তুষ-তুষালি ব্রত, পুন্যপুকুর ব্রত, সাবিত্রী ব্রত, লক্ষ্মীর ব্রত ইত্যাদি। এগুলোর মাধ্যমে মেয়েরা গৃহের শান্তি ও কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে, এ বিশ্বাস ছিল সবার মনে।


    ধাঁধা: ধাঁধা লোকসাহিত্যের অন্যতম প্রাচীন শাখা। এর মধ্যে সূক্ষ্ম বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। মাহবুবুল আলমের ভাষায় ‘এতে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের যে নিদর্শন পাওয়া যায় তাতে তাকে কেবল আদিম মানুষের সৃষ্টি মনে না করে বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানব মনের সৃষ্টি বলে বিবেচনা করাই যৌক্তিক মনে হয়।’ যেমন- ক) আকাশ গুড় গুড় পাথর ঘাটা, সাতশ ডালে দুইটা পাতা। খ) বাগান থেকে বেরুল টিয়ে, সোনার টোপর মাথায় দিয়ে গ) আকাশ থেকে পড়ল এক বুড়ি, তার মাথায় চুলের ঝুড়ি। এই তিনটি ধাঁধার উত্তর যথাক্রমে ‘চাঁদ ও সূর্য’, আনারস এবং ঢোল।


    প্রবাদ-প্রবচনঃ গ্রাম বাংলার সহজ সরল মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানচর্চা হচ্ছে প্রবাদ প্রবচন। প্রবাদ প্রবচনে শব্দ-বিন্যাস খুব সংযত হয় তাই একে কাব্যিক মর্যাদা দেওয়া যায়। বাংলার কৃষক সমাজে প্রবাদ হলো জ্ঞান ও সত্য প্রচারের মাধ্যম। প্রবাদ বাক্যের মাধ্যমে তারা নৈতিক ধারণা পেত। এখনও পর্যন্ত এগুলো পল্লীসমাজে সযত্নে লালিত হচ্ছে। উদাহরণ-


    ক) ‘নানা বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ


    জগৎ ভরিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।’


    খ) ‘চিড়া বলো পিঠা বলো ভাতের মতো না,


    খালা বলো ফুফু বলো মায়ের মতো না।’


    খনার বচন, ডাকের কথা প্রভৃতিও প্রবাদ বাক্যের অন্তর্গত। ডাক ও খনার বচন বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনের সাথে মিশে আছে। উদাহরণ-


    ক.) চার চাষে ধান/তার অর্ধেক পান


    ষোল চাষে মূলা/তার অর্ধেক তুলা।


    খ) কলা রুয়ে না কেটো পাত


    তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।


    বাংলা লোক সাহিত্যের ধারা রচনা


    লোকসাহিত্য সংরক্ষণ: গ্রামের অশিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত, সুফিসাধক, মাঝি-মাল্লা, চাষি, বৈরাগী ও লোককবিরা লোক সাহিত্যের রচয়িতা। কিন্তু এগুলো যখন প্রায় বিলুপ্ত তখন শুরু হলো সংরক্ষণের প্রচেষ্টা। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে লোক সাহিত্য সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়। রেভারেন্ড লাল বিহারী তাঁর Folk Tales of Bengal বইটি রচনা করে লোকসাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তারপর থেকেই লোকসাহিত্যের সংগ্রহের দিকে সবাই মনোযোগ দেয়। ড. দীনেশচন্দ্র সেন এবং চন্দ্রকুমার দে সংগ্রহ করে ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ ও মৈমনসিংহ গীতিকা।’ ড. সুনীল কুমার দে ‘প্রবাদ সংগ্রহে’ কয়েক হাজার ছড়া ও প্রবাদ সংগ্রহ করেছেন। মনসুউদ্দীন সাহেব ‘হারামনি’, মাযহারুল ইসলাম ‘বাগলা কানাই’ নাম দিয়ে লোকসাহিত্যের বিরাট এক অংশকে বইয়ে প্রকাশ করেন। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার বাংলা রূপকথাগুলো যেন প্রাণ দিয়েছেন তার ‘ঠাকুরদার ঝুলি’ এবং ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ গ্রন্থে। বর্তমানে ড. আশরাফ সিদ্দিকী এবং ড. মাযহারুল ইসলাম লোকসাহিত্য সম্পর্কে গবেষণা করে যাচ্ছেন।


    উপসংহার: লোকসাহিত্য বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্য। এটি সহজ ও সাবলীল ভাষায় গ্রামের সাধারণ মানুষের কথা বলে। লোকসাহিত্য খাঁটি বাংলা সাহিত্যের উদাহরণ। সুতরাং গ্রামীণ মানুষের হাজার বছরের লালিত এই সকল লোকসাহিত্য যথাযথ পরিচর্যা এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে বাংলার মানুষের মনে বেচে থাকবে হাজার বছর।


    Tag : প্রবন্ধ রচনা বাংলাদেশের লোকসাহিত্য, বাংলাদেশের লোকসাহিত্য প্রবন্ধ রচনা, বাংলা লোক সাহিত্যের ধারা রচনা, লোক সাহিত্যের ইতিহাস প্রবন্ধ রচনা, 

    Next Post Previous Post
    No Comment
    Add Comment
    comment url

     আমাদের সাইটের সকল পিডিএফ এর পাসওয়ার্ড হচ্ছে timeofbd.com