ইমানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলি Imaner Important bisoyguli

আসসালামুআলাইকুম। আশাকরি সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে সকলে সুস্থ আছেন। timeofbd.com এর পক্ষ থেকে সকলকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

প্রিয় পাঠকবৃন্দ, আশাকরি আল্লাহর রহমতে সবাই ভালো আছেন। আপনাদের জানাতে যাচ্ছি ইমানের সজ্ঞা, ইমানের গুরত্ব, ইমানের স্তর, ইমানের স্তম্ভ, ইমানের পরিচয়, ইমানের রুকন, ইমানের পরিক্ষা,  প্রভৃতি ইমানের বিষয়সমূহ সম্পর্কে। আপনারা অনেকেই ইমানের সজ্ঞা, ইমানের গুরত্ব, ইমানের স্তর, ইমানের স্তম্ভ, ইমানের পরিচয়, ইমানের রুকন, ইমানের পরিক্ষা, প্রভৃতি ইমান সম্পর্কিত বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন না। জানতে চাইলেও কাজের চাপে বা অন্যান্য কারণে  এ সম্পর্কিত তথ্য খোজার জন্য ইসলামি পুস্তকসমূহ জোগাড় করে পড়া বা কুরআন ও হাদিস গবেষণা করে তথ্যগুলো বের করার সময় হয়ে ওঠেনা। তাই আপনাদের ইমানের সজ্ঞা, ইমানের গুরত্ব, ইমানের স্তর, ইমানের স্তম্ভ, ইমানের পরিচয়, ইমানের রুকন, ইমানের পরিক্ষা, প্রভৃতি ইমান সম্পর্কিত বিষয়সমূহের জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য এবং আপনাদের সময় বাচানোর জন্য আমরা এ সমর্কে যাবতীয় তথ্য আপনাদের মাঝে উপস্থাপন করবো।


                               

ঈমানের, ঈমানের স্তর কয়টি, ঈমানের সংজ্ঞা, ঈমানের গুরুত্ব, ঈমানের হাকীকত, ঈমানের হাকীকত, ঈমানের স্তম্ভ কয়টি, দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ, ঈমানের পরিচয়, ঈমানের শর্ত কয়টি ও কি কি, পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ হাদিস, ঈমানী কথা, ঈমানের পরীক্ষা, ঈমানের বহিঃপ্রকাশ কোনটি, ঈমানের রুকন কয়টি ও কি কি, দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ জাল হাদিস, ঈমানের অগ্নি পরীক্ষা, ঈমানের বিপরীত, ঈমানের ওয়াজ


                   

    ইমান | ইমান কি | ইমান কাকে বলে

    আল্লাহ ও রাসুল (সা) আমাদের যা আদেশ ও নিষেধ করেছে তা মুখে স্বীকার করা, অন্তরে বিশ্বাস করা এবং তদানুযায়ী আমল করাকে ইমান বলে।


    ইমানের শর্তসমূহ | ইমানের শর্ত কয়টি | ইমানের শর্ত কয়টি ও কি কি

    ইমানের মূলশর্ত ৩টি। 

    (১) মুখে স্বীকার করাঃ আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি সর্বশক্তিমান এবং সবকিছুর মালিক। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে আমাদের যা কিছু আদেশ করেছেন তা নিঃসন্দেহে পালন করা এবং যা নিষেধ করেছছেন তা থেকে বিরত থাকা এবং রাসূল (সা) হাদিসে আমাদের যে পথ দেখিয়েছেন সেই পথ অনুসরন করাই হলো ইমান। এগুলো সর্বপ্রথম মুখে স্বীকার করতে হবে।

    (২) অন্তরে বিশ্বাস করাঃ উপরোক্ত বিষয়গুলো মুখে স্বীকার করার পাশাপাশি অন্তরে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। মুখে স্বীকার করে বিশ্বাস করলে মুনাফিক হয়ে যাবে। আল্লাহ বলেন," তারা যখন ঈমানদার লোকদের সঙ্গে মিলিত হয়, তখন বলে আমরা ঈমান এনেছি। কিন্তু নিরিবিলিতে যখন তারা তাদের শয়তানদের সঙ্গে একত্রিত হয়, তখন তারা বলেন, আসলে আমরা তোমাদের সঙ্গেই রয়েছি, আর উহাদের সঙ্গে আমরা শুধু ঠাট্টাই করি মাত্র। (সূরা বাকারা, আয়াত ১৪)"

    (৩) তদানুযায়ী আমল করাঃ উক্ত বিষয়গুলো  মুখে স্বীকার করা, অন্তরে  বিশ্বাস করার পাশাপাশি সেই অনুযায়ী কাজও করতে হবে। আমি যে ইমান এনেছি তার প্রতিফলন দেখাতে হবে। 


    উপরেরর ৩টি শর্ত পূরণ করলেই তবে কাউকে পূর্ণ ঈমানদার বলা যাবে।

    ইমানের স্তম্ভ | ইমানের স্তম্ভ কয়টি | ইমানের স্তম্ভ কয়টি ও কি কি

    ইমানের স্তম্ভ বা হাকিকত বা স্বরূপ বা রুকন ৭টি। এই ৭টি বিষয়ের উপরে আমাদের অবশ্যই বিশ্বাস রাখতে হবে।


    একদিন জিবরাঈল (আ) মানুষের ছদ্মবেশ ধরে রাসুলুল্লাহ (সা) এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন "ঈমান (এর হাকিকত) কী?" জবাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, "ঈমানের হাকিকত বা স্বরূপ হলো, তুমি বদ্ধমূলভাবে বিশ্বাস স্থাপন করবে আল্লাহ তাআলার প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, আসমানি কিতাবগুলোর প্রতি, আল্লাহর নবী-রাসুলদের প্রতি, কিয়ামত দিবসের প্রতি, তাকদিরের প্রতি, (অর্থাৎ এ কথা বিশ্বাস করা, ভালো-মন্দ সব কিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত হয়) এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের প্রতি।’ (সহিহ বুখারি)


    সুতরাং ইমানের স্তম্ভ বা হাকিকত বা স্বরূপ বা রুকন ৭টি। 

    (১) আল্লাহঃ ঈমানের ছয়টি মৌলিক স্তম্ভের প্রথম এবং প্রধান স্তম্ভ হলো মহান আল্লাহর ওপর ঈমান তথা বিশ্বাস স্থাপন করা। আল্লাহর ওপর ঈমান আনার অর্থ এ কথা বিশ্বাস করা, আল্লাহ এক, অদ্বিতীয় ও অতুলনীয়। তাঁর কোনো অংশীদার নেই, তাঁর কোনো কিছুর অভাব নেই। তিনিই সবার সব অভাব পূরণকারী। তিনি কারো বাবা নন, ছেলেও নন। তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। একমাত্র তিনিই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা ও পালনকর্তা, বিধানদাতা। আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই। তিনিই একমাত্র ইবাদত পাওয়ার যোগ্য। তিনি চিরঞ্জীব, তাঁর কোনো মৃত্যু নেই। তিনি ছাড়া অন্য সব কিছুই ক্ষয়শীল ও ধ্বংসপ্রাপ্ত; কিন্তু তাঁর ক্ষয়ও নেই, ধ্বংসও নেই। সব কিছুর ওপরই তাঁর ক্ষমতা চলে। কিন্তু তাঁর ওপর কারো ক্ষমতা চলে না


    (২) ফেরেশতাঃ ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান বা বিশ্বাস স্থাপনের অর্থ হলো, ফেরেশতাদের অস্তিত্ব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা। তাঁরাও আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি। কিন্তু মানুষের মত তারা ছেলে বা মেয়ে নয়। ইন্দ্রিয়জাত কোনো তাড়না নেই। আল্লাহ তাঁদের যা আদেশ করেন, তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে তা পালন করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ তারা ছেলেও নয় মেয়েও নয়। বরং ফেরেশতারা তো আল্লাহর সম্মানিত বান্দা। তারা আগ বাড়িয়ে কথা বলতে পারে না এবং তারা তাঁর আদেশেই কাজ করে।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ২৬-২৭)


    (৩) আসমানি কিতাবঃ আল্লাহ তাআলা মানুষের পথপ্রদর্শনের জন্য নবী-রাসুলদের ওপর বিভিন্ন আসমানি কিতার নাজিল করেছেন। সেই কিতাবগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাও ঈমানের মৌলিক স্তম্ভ। আলাহ তায়ালা মোট ১০৪ খানা আসমানি কিতাব নাযিল করেছেন। ৪খানা বড় এবং ১০০ খানা ছোট। এগুলো মোট ৮ জন নবির উপর নাযিল হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেছেন, "আপনি বলুন, আল্লাহ যে কিতাব নাজিল করেছেন, আমি তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি।’ (সুরা : শুরা, আয়াত : ১৫)


    (৪) নবী রাসুলঃ : আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে অনেক নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। যাদের উপর আসমানি কিতাব নাযিল হয়েছে তারা রাসূল। আর যাদের উপর নাযিল হয়নি তারা নবি। নবিরা পূর্ববর্তী রাসুলদের দেখানো পথে দাওয়াত দিতেন। সেই নবি ও রাসুলদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাও ঈমানের মৌলিক স্তম্ভের অন্তর্ভুক্ত। দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস পোষণ করা যে আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক জাতির জন্য একজনকে রাসুল বানিয়ে পাঠিয়েছেন। যিনি তাদের এক আল্লাহর ইবাদত করার এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছুর ইবাদতকে অস্বীকার করার দাওয়াত দেন। সব রাসুল সত্যবাদী, সত্যায়নকারী, পুণ্যবান, সঠিক পথের দিশারি, তাকওয়াবান ও বিশ্বস্ত। নবী-রাসুলরা মাসুম তথা নিষ্পাপ। আল্লাহ তাঁদের যা কিছু দিয়ে পাঠিয়েছেন তাঁরা তা পরিপূর্ণভাবে পৌঁছে দিয়েছেন। কোনো অংশ গোপন বা পরিবর্তন করেননি। নিজে থেকে কোনো সংযোজন বা বিয়োজন করেননি। আল্লাহ বলেন, ‘...রাসুলদের দায়িত্ব তো শুধু সুস্পষ্ট বাণী পৌঁছে দেওয়া।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৩৫)

    (৫) কিয়ামতঃ কিয়ামত শব্দের অর্থ উঠে দাঁড়ানো। এটি আরবি শব্দ কিয়াম থেকে আগত যার অর্থ উঠা(ক্রিয়া হিসেবে ব্যবহৃত)। ইসলামী আকীদা অনুসারে, ইসরাফীল (আ.) শিঙ্গায় ফুৎকার দিলে কিয়ামত হবে, অর্থাৎ বিশ্বজগৎ ধ্বংস হবে। প্রথম ফুৎকার দেওয়ার সাথে সথেই আকাশ ফে‌টে যা‌বে, তারকাসমূহ খ‌সে পড়‌বে, পাহাড়-পর্বত ছিন্ন-‌বি‌চ্ছিন্ন হ‌য়ে তুলার মত উড়‌তে থাক‌বে। সকল মানুষ ও জীব-জন্তু ম‌রে যা‌বে, আকাশ ও সমগ্র পু‌থিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। দ্বিতীয় ফুৎকার দেওয়ার সাথে সাথেই পৃথিবী সৃষ্টি থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যত সৃষ্টজীবের আর্বিভাব হয়েছিল, তারা সকলেই জীবিত হয়ে উঠে দাঁড়াবে।

    (৬) তাকদিরে বিশ্বাসঃ তাকদিরে বিশ্বাস করা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাকদিরের শব্দমূল হচ্ছে কদর। এর অর্থ হচ্ছে পরিমাণ নির্ধারণ, পরিমাপ, পরিমিতি, মূল্যায়ন, নির্দিষ্ট সীমা, মূল্য নিরূপণ, অদৃষ্ট, নিয়তি, ভাগ্য ইত্যাদি। তাকদির হচ্ছে আল্লাহর বিশ্বজনীন নিয়মনীতি। এ নিয়মনীতি ও ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার অধীনে বিশ্বজগৎ পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন, এ চেতনা লালন করা এবং তাঁর বিধিব্যবস্থায় সন্তুষ্ট থাকার মধ্যেই শান্তি ও মঙ্গল নিহিত রয়েছে। কোনো কল্যাণকর কিছু ঘটলে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে। আর অকল্যাণকর কিছু ঘটলে তাওবা-ইস্তেগফার এবং ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সেই সঙ্গে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য পাওয়ার ইচ্ছা প্রবল করতে হবে এবং তদনুযায়ী আমল বা চেষ্টা-তদবির করে যেতে হবে।

    (৭) মৃত্যুর পর পুনরুত্থানঃ মৃত ব্যক্তিদের কবর থেকে আবার জীবিত করা হবে। সব মানুষ আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হবে। তাদের পোশাক ও জুতা এক জায়গায় একত্র করা হবে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের এরপর মৃত্যুবরণ করতে হবে। অতঃপর নিশ্চয়ই তোমাদের কিয়ামতের দিন আবার উঠানো হবে। (সুরা :  মুমিনুন, আয়াত : ১৫-১৬)। এদিন সবাইকে আল্লাহর কাছে দুনিয়ার সমস্ত কাজের হিসাব দিতে হবে। আল্লাহ কর্মফল অনুযায়ী জান্নাত আর জাহান্নাম নির্ধারণ করবেন।


    ইমানের গুরুত্ব

    সন্দেহ নেই, আল্লাহর নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো ঈমান। আবু যার রা: বর্ণনা করেছেন, এক সাহবি একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করেছিলেন, "ইয়া রাসুলাল্লাহ! কোন্ আমলটি সর্বোত্তম? জবাবে তিনি বলেন, আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাঁর পথে জিহাদ।
    (সহিহ মুসলিম)

    হিদায়াত এবং ইহ ও পরকালীন সুখ-সৌভাগ্যের কারণ হলো ঈমান। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন:
    , অতঃপর আল্লাহ যাকে পথ-প্রদর্শন করতে চান, তার বক্ষকে ইসলামের জন্যে উম্মুক্ত করে দেন। (সুরা: আন'আম, আয়াত: ১২৫)

    ঈমানদারকে তার ঈমান আল্লাহর নাফরমানী ও গুনাহ থেকে বিরত রাখে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন, যাদের মনে ভয় রয়েছে, তাদের উপর শয়তানের আগমন ঘটার সাথে সাথেই তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং তখনই তাদের বিবেচনাশক্তি জাগ্রত হয়ে উঠে। (সুরা: আ'রাফ, আয়াত: ২০১)

    আমল গ্রহণযোগ্য হওয়ার পূর্বশর্ত ঈমান। আল্লাহ তা'আলা বলেন, আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে, যদি আল্লাহর শরীক স্থির করেন, তবে আপনার কর্ম নিষ্ফল হবে এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের একজন হবেন। (সুরা: যুমার, আয়াত: ৬৫)

    সুতরাং খাঁটি ঈমানের দ্বারা আল্লাহ তা'আলা আমলে বরকত দান করেন এবং দু'আ সমূহ কবুল করেন। সুতরাং ইমানের গুরুত্ব অপরিসীম।



    পবিত্রতা ইমানের অংশ | পবিত্রতা ইমানের অঙ্গ হাদিস

    মহানবি হযরত মুহম্মদ (সা) বলেছেন, 

                  " আতহুরুস্ সাতরুল ইমান"

           বাংলা অর্থঃ পবিত্রতা ইমানের অঙ্গ।

    ইসলাম মানুষের পূতপবিত্র জীবনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। মহানবী (সা.) পবিত্রতাকে ঈমানের অংশ ঘোষণা করেছেন এবং নামাজসহ একাধিক ইবাদতের জন্য পবিত্রতার শর্তারোপ করেছে ইসলামী শরিয়ত। একাধিক আয়াত ও হাদিসে মুমিনদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে পবিত্র জীবনের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

    আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ইসলাম পরিচ্ছন্ন। সুতরাং তোমরা পরিচ্ছন্নতা অর্জন করো। নিশ্চয়ই জান্নাতে কেবল পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিই প্রবেশ করবে।’ (ফাইজুল কাদির, হাদিস : ৩০৬৫)

    অন্য হাদিসে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর দ্বিনের ভিত্তি স্থাপিত।’ (মাউসুআতু আতরাফিল হাদিস আন-নাবাবি)

    পবিত্রতা নামাজ কবুলের পূর্বশর্ত। পবিত্র শরীর ও কাপড় ছাড়া ব্যক্তির নামাজ আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পবিত্রতা নামাজের চাবি।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)

    অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, ‘... আর পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক।’ (সুনানে তিরমিজি)

    আল্লাহ বলেন, " আল্লাহ তোমাদের কষ্ট দিতে চান না;  বরং তোমাদের পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করতে চান। যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো।" (সুরা মায়িদা, আয়াত ৬)

    আল্লাহ বলেন, "যে মসজিদের ভিত্তি প্রথম দিন থেকেই আল্লাহভীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, সেটাই আপনার নামাজের জন্য অধিক যোগ্য। সেখানে এমন লোক রয়েছে, যারা পবিত্রতা অর্জন করতে ভালোবাসে। আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন।" (সুরা তাওবা, আয়াত ১০৮)

    পবিত্রতা মুমিন জীবনের সৌন্দর্য। মুমিন দেহ ও মনের দিক থেকে সব সময় পবিত্র থাকার চেষ্টা করবে। অপবিত্রতা থেকে নিজের দেহ-মনকে রক্ষা করবে।

    রাসুল্লাহ (সা) বলেছেন, "প্রকৃত মুমিন ছাড়া আর কেউই অজুর প্রতি যত্নবান হয় না।" (মুসনাদে আহমদ)

    সুতরাং, ইমান অর্জনের জন্য পবিত্রতার গুরুত্ব মহৎ।


     ইমানী পরিক্ষা 

    শুধু মৌখিকভাবে ঈমান আনলেই কোনো ব্যক্তি প্রকৃত ঈমানদার হওয়ার দাবিদার নয়। প্রকৃত ঈমানদার হওয়ার জন্য তাকে জান-মাল ও নানা বিপদ-আপদে ইমানী পরিক্ষায়ও উত্তীর্ণ হতে হবে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে আল্লাহ পাক বলেন, 'তোমরা কি মনে করেছ যে, তোমরা কোনো পরীক্ষা দেয়া ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করবে, যেমনটি তোমাদের পূর্বের লোকদের পরীক্ষা করা হয়েছিল? তারা কঠোর দারিদ্রতা ও মুশকিল দ্বারা ব্যথিত হয়েছিল এবং এমনভাবে প্রকম্পিত হয়েছিল যে, এমনকি রাসূল ও তার সঙ্গে থাকা ঈমানদারগণ বলে উঠেছিল, 'আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে। হ্যা। নিঃসন্দেহে আল্লাহর সাহায্য নিকটেই।' (সূরা বাকারা, আয়াত ২১৪)

    আল্লাহ তাআ'লা বলেন, 'এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।' (সূরা বাকারা, আয়াত ১৫৫) তিনি আরও বলেন, 'অবশ্য ধন-সম্পদে এবং জনসম্পদে তোমাদের পরীক্ষা হবে এবং অবশ্য তোমরা শুনবে পূর্ববর্তী আহলে কিতাবদের কাছে এবং মুশরেকদের কাছে বহু অশোভন উক্তি। আর যদি তোমরা ধৈর্য্য ধারণ কর এবং পরহেজগারী অবলম্বন কর, তবে তা হবে একান্ত সৎসাহসের ব্যাপার। (সূরা  আলে ইমরান, ই
    আয়াত ১৮৬)



    দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ সহিহ না কি                        জাল হাদিস

                      “দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ”

    ইবন জাওযি একে জাল হাদিস বলে প্রমাণ করেছেন।

    এই হাদিসটি মুসলমানদের মিথ্যা আশা দেয় যে তারা দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা না করেও দেশ প্রেমের জন্য জান্নাতে যেতে পারবে। যেই দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় নি এবং যেই দেশের সরকার ইসলামের নিয়ম অনুসারে দেশ পরিচালনা করে না, সেই দেশের জন্য প্রেম ঈমানের অঙ্গ হতে পারে না। ঈমানের একটি অত্যাবশ্যকীয় দাবি হচ্ছে আল্লাহ যেটা আমাদের জন্য ভালো বলেছেন সেটাকে মনে প্রাণে ভালো মানা এবং আল্লাহ আমাদের জন্য যেটাকে খারাপ বলেছেন, সেটাকে মনে প্রাণে ঘৃণা করা। এই ধরণের জাল হাদিস ব্যবহার করা হয় ধর্মের দোহাই দিয়ে দেশের মুসলমানদের মধ্যে দেশের প্রতি অন্ধ ভালবাসা সৃষ্টি করার জন্য। কাফির সরকার দ্বারা পরিচালিত কাফির শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত একটি দেশের প্রতি প্রেম আর যাই হোক, অন্তত আল্লাহর প্রতি ঈমানের অঙ্গ নয়। তবে এটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে দেশের আইন মেনে চলা এবং দেশের উপকার করা মুসলমানদের জন্য অত্যাবশ্যকীয়, যতক্ষণ না সেটা ধর্মের বিরুদ্ধে না যাচ্ছে।

    আমাদের দেশের মানুষের মুখে মুখে, বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতায় প্রায় শোনা যায়, পত্র-পত্রিকা এবং বই-পুস্তকেও লেখা থাকে “দেশ প্রেম ইমানের অঙ্গ ।” এমনকি কতিপয় বক্তার ওয়াজের মধ্যেও হাদিস হিসেবে বলতে শুনা যায়,
               ِحُبِّ الوَطَنِ مِنَ الإيمان
     
    বাংলা উচ্চারণঃ হুব্বুল ওয়াতানে মিনাল ইমান।

    বাংলা অর্থঃ দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ।

    কিন্তু হাদিস বিশারদগণের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে একটি মিথ্যাচার। মুহাদ্দিসদের পরিভাষায় এমন হাদিসকে মওযু বা বানোয়াট হাদিস বলা হয়।

    ** বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ইমাম সাগানী তার ‘আল মাওযূআত’ বা বানোয়াট হাদিস শীর্ষক গ্রন্থে এ হাদিস সম্পর্কে বলেন: موضوع বা বানোয়াট (হাদিস নং ৮১)

    ** শাইখ আলবানী রহঃ বলেন:
    “দেশপ্রেম ইমানের অন্তর্ভুক্ত” এটি বানোয়াট হাদিস যেমনটি ইমাম সাগানী এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ বলেছেন।

    এর মর্মার্থটি সঠিক নয়। কারণ দেশের প্রতি ভালবাসা থাকা নিজের জীবন ও অর্থ-সম্পদের প্রতি ভালবাসা থাকার মতই একটি বিষয়। এগুলো মানুষের স্বভাবগত প্রবৃত্তি। সুতরাং এই ভালবাসা যেমন বিশেষ প্রশংসা পাওয়ার হকদার নয় তেমনি এটি ইমানের অপরিহার্য অনুষঙ্গও নয়। কেননা, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই এই ভালবাসা বিদ্যমান রয়েছে-চাই সে মুমিন হোক অথবা কাফের হোক।” (সিলসিলা যঈফা হাদিস নং ৩৬)

    ** শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমীন (রহ) বলেন,
    “দেশকে ভালবাসা ঈমানের অঙ্গ” কথাটিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস হিসেবে বলা হয়ে থাকে। এটি একটি মিথ্যাচার। দেশকে ভালবাসতে হলে এ কারণে ভালবাসতে হবে যে, সেটি ইসলামি রাষ্ট্র। যদিও তা আপনার জন্মভূমি হোক বা দূরের কোনো দেশ হোক।সবগুলোই ইসলামী দেশ। প্রতিটি ইসলামি দেশকে রক্ষা করা আমাদের জন্য অপরিহার্য।”
    (শাইখ আল্লামা উসাইমীন রহ. কর্তৃক রিয়াযুস সালেহীন গ্রন্থের ব্যাখ্যা)

    যাহোক, দেশের প্রতি ভালবাসা থাকা মানুষের প্রকৃতিগত বিষয়। সকল ধর্মের লোকই তাদের দেশকে ভালবাসে। কিন্তু কোনো ইসলামি দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকাটা মুসলিম ও সুনাগরিক হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, কোনো ইসলামী দেশ যদি কাফের দেশ দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন ঐ দেশে বসবাসকারী প্রতিটি মুসলিমের জন্য সর্বাত্তকভাবে কাফেরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা অপরিহার্য হয়ে যায়। আবার অন্য দিকে দেশ থেকে যদি ইসলাম পালন করা অসম্ভব হয়ে যায় এবং জান-মাল ও ইজ্জত-সম্ভ্রম অনিরাপদ পড়ে তখন দেশ ছেড়ে ‘হিজরত’ও করতে হতে পারে।

    সুতরাং দেশকে ভালবাসতে হবে, একতাবদ্ধ থেকে দেশের কল্যাণে অবদান রাখতে হবে এবং দেশ বিরোধী সকল অন্যায় কার্যক্রম ও ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় প্রতিটি মুসলিমদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু তা “দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ” এমন মিথ্যা হাদিসের উপর ভিত্তি করে নয় বরং দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ ও প্রকৃতিগত ভালবাসা থেকে।

    ইমানের বিপরীত কী


    ইমানের বিপরীত হচ্ছে কুফর। ইমানের ৭টি মৌলিক বিষয় আছে। 

     (১) আল্লাহ
    (২) ফেরেশতা
    (৩) আসমানি কিতাব
    (৪) নবী-রাসূল
    (৫) কিয়ামত
    (৬) তাকদীর
    (৭) মৃত্যুর পর পুররুত্থান

    এই ৭টি বিষয়ের যেকোনো একটিকে অস্বীকার করলে সেটা কুফরির শামিল হবে।  আর যে কুফরি করে তাকে কাফির বলে। কুফরি একটি কবিরা গুণাহ। কুফরি সম্পর্কে কুরআনে সুস্পস্ট শাস্তির কথা উলেখ রয়েছে।

    যারা কুফর বা আল্লাহকে অস্বীকার করে, কুরআনুল কারিমের তাদের ব্যাপারে কঠোর শাস্তির কথা ঘোষণা করা হয়েছে। আর কুরআনে যে কাজে শাস্তির ঘোষণা এসেছে, সে কাজগুলোই কবিরা গোনাহ। তার মধ্যে কুফর বা আল্লাহকে অস্বীকারও একটি। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা একাধিক আয়াতে ঘোষণা করেন-

    " নিশ্চয় যারা কুফরি করে এবং কাফের অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করে, সে সব লোকের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ, ফেরেশতাদের অভিশাপ এবং সব মানুষের অভিশাপ। এরা চিরকাল এ অভিশাপের মাঝেই থাকবে। তাদের উপর থেকে আজাব কখনও হালকা করা হবে না বরং এরা বিরামও পাবে না।" (সুরা বাকারা,  আয়াত ১৬১-১৬২)

    "যার উপর জবরদস্তি করা হয় এবং তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে সে ব্যতিত যে কেউ বিশ্বাসী হওয়ার পর আল্লাহতে অবিশ্বাসী হয় এবং কুফরীর জন্য মন উম্মুক্ত করে দেয় তাদের উপর আপতিত হবে আল্লাহর গজব এবং তাদের জন্যে রয়েছে শাস্তি।" (সুরা নাহল, আয়াত ১০৬)

    "হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন কর এবং বিশ্বাস স্থাপন কর তাঁর রাসুল ও তাঁর কিতাবের উপর, যা তিনি নাজিল করেছেন স্বীয় রাসুলের উপর এবং সেসমস্ত কিতাবের উপর, যেগুলো নাজিল করা হয়েছিল ইতিপূর্বে। যে আল্লাহর উপর, তাঁর ফেরেশতাদের উপর, তাঁর কিতাব সমূহের উপর এবং রসূলগণের উপর ও কিয়ামতদিনের উপর বিশ্বাস করবে না, সে পথভ্রষ্ট হয়ে বহু দূরে গিয়ে পড়বে।’ (সুরা নিসা, আয়াত ১৩৬)

    "যারা আল্লাহ ও তার রাসুলকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি বিশ্বাসে তারতম্য করতে চায় আর বলে যে, আমরা কিছু বিষয় বিশ্বাস করি এবং কিছু বিষয় অস্বীকার করি আর এরই মধ্যবর্তী কোনো পথ অবলম্বন করতে চায়। প্রকৃতপক্ষে এরাই সত্য প্রত্যাখ্যাকারী। আর যারা সত্য প্রত্যাখ্যানকারী (আল্লাহ বলেন) তাদের জন্য তৈরি করে রেখেছি অপমানজনক আজাব।" (সুরা নিসা, আয়াত ১৫০-১৫১)

    উল্লেখিত কুরআনের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহকে অবিশ্বাস করা কুফর। এটি কবিরা গোনাহ। এ গোনাহকারীদের জন্য রয়েছে সবচেয়ে বড় যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি। এমনকি যারা কুফর করে তাদের ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্তুতিও আল্লাহর সামনে তাদের কোনো কাজে আসবে না। তারা হবে জাহান্নামি। আল্লাহ তাআলা বলেন-

    "যারা কুফরি করে, তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি আল্লাহর সামনে কখনও কোনো কাজে আসবে না। আর তারাই হচ্ছে দোযখের ইন্ধন।" (সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১০)

    "যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করে এবং অন্যায়ভাবে পয়গম্বরগণকে হত্যা করে আর সেসব লোককে হত্যা করে যারা ন্যায়পরায়ণতার নির্দেশ দেয় তাদেরকে বেদনাদায়ক শাস্তির সংবাদ দিন। এরাই হলো সেসব লোক যাদের সব আমল দুনিয়া ও আখেরাত দুটিই বিনষ্ট হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে তাদের কোনো সাহায্যকারীও নেই।" (সুরা আল-ইমরান, আয়াত ২১-২২)

    সুতরাং আমরা ইমানদার হবো এবং কুফরি করা থেকে বিরত থাকবো।



    ট্যাগঃ ঈমানের, ঈমানের স্তর কয়টি, ঈমানের সংজ্ঞা, ঈমানের গুরুত্ব, ঈমানের হাকীকত, ঈমানের হাকীকত, ঈমানের স্তম্ভ কয়টি, দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ, ঈমানের পরিচয়, ঈমানের শর্ত কয়টি ও কি কি, পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ হাদিস, ঈমানী কথা, ঈমানের পরীক্ষা, ঈমানের বহিঃপ্রকাশ কোনটি, ঈমানের রুকন কয়টি ও কি কি, দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ জাল হাদিস, ঈমানের অগ্নি পরীক্ষা, ঈমানের বিপরীত, ঈমানের ওয়াজ